যে মানসিক রোগ আপনাকে সফল মানুষ বানাতে পারে




নিজেকে ভালবাসা একটি ভাল গুন। কিন্তু অতিরিক্ত নিজেকে ভালবাসলে তা এক ধরণের মানসিক রোগ। এই রোগকে নারসিজম বলে। তবে সবসময় এটি  গুরুতর সমস্যা নয়। কিছু মাত্রার নারসিজম স্বাভাবিক এবং উপকারি  হতে পারে, বিশেষ করে আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে।জীবনে সফল হতে হলে আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার দরকার আছে। 


 নারসিজম সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য নিচে দেওয়া হলো:


গ্রিক পুরাণের চরিত্র থেকে নামকরণ

   নারসিজমের নাম এসেছে গ্রিক পুরাণের নার্সিসাস নামের এক চরিত্র থেকে। নার্সিসাস ছিল এক যুবক, যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে সে তার নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে মারা যায়। তার গল্প আত্মমুগ্ধতার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে।


নারসিজমের বিভিন্ন ধরণ

   নারসিজমের প্রধানত দুইটি ধরন রয়েছে: গ্র্যান্ডিওস এবং ভালনারেবল।

   গ্র্যান্ডিওস নারসিজম: 

এ ধরনের মানুষরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করেন, অতিরিক্ত মনোযোগ চান এবং তারা সাধারণত দৃঢ় এবং বহির্মুখী হন।

   ভালনারেবল নারসিজম: 

এ ধরনের মানুষরা নিজেদের অনিরাপদ মনে করেন, প্রশংসার আকাঙ্ক্ষা করেন এবং সাধারণত অন্তর্মুখী হন। তারা সাধারণত রক্ষণাত্মক বা অতিসংবেদনশীল হয়ে থাকেন।


আরও পড়ুনঃ 


স্বৈরাচাররা যে মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে


আক্রমণাত্মক আচরণ

   বাহ্যিক আত্মবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও, অনেক নারসিস্টের আত্মসম্মান আসলে নাজুক হয়। তারা প্রায়ই অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে চান তাদের মান বজায় রাখতে এবং সমালোচনা তাদের গভীরভাবে আঘাত করতে পারে, যা প্রতিরক্ষামূলক বা আক্রমণাত্মক আচরণ  তৈরি করে।




সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নারসিজম

   কিছু গবেষণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সাথে নারসিস্টিক আচরণের সংযোগের কথা বলে। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম, যা আত্মপ্রচারণা এবং লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে স্বীকৃতি পেতে উৎসাহিত করে, নারসিস্টিক প্রবণতা বাড়াতে পারে।


জিনগত ও পরিবেশগত প্রভাব

   নারসিস্টিক বৈশিষ্ট্য জিনগত এবং পরিবেশগত উভয় প্রভাবের অধীনে থাকতে পারে। শিশুদের যখন অতিরিক্ত প্রশংসা করা হয় বা অত্যধিক সমালোচনা করা হয়, তখন তারা নারসিস্টিক প্রবণতা নিয়ে বড় হতে পারে।


নারসিস্টিক ক্রোধ

   যখন তাদের অতিরিক্ত আত্ম-ভাবনার প্রতি হুমকি আসে, তখন নারসিস্টরা তীব্র রাগ বা শত্রুতা প্রকাশ করতে পারে, যা নারসিস্টিক রাগ নামে পরিচিত। এটি সাধারণত তখন ঘটে যখন তারা অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত বা সমালোচিত বোধ করেন।


নারসিস্টরা আকর্ষণীয় হতে পারেন

   নারসিস্টরা প্রায়ই প্রথমে একটি চমৎকার প্রভাব তৈরি করতে পারেন। তাদের আকর্ষণ, আত্মবিশ্বাস এবং ক্যারিশমা মানুষকে প্রাথমিকভাবে আকর্ষণ করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কগুলোতে তাদের প্রকৃত চরিত্র প্রায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


নিজেকে উন্নত করার কৌশল

   নারসিস্টরা নিজেদের উন্নত করতে নানা কৌশল ব্যবহার করেন। এর মধ্যে রয়েছে নিজেদের প্রশংসা করা, অন্যদের ছোট করে দেখা এবং তাদের অর্জনগুলোকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো যাতে তারা তাদের অতিরিক্ত আত্মসম্মান বজায় রাখতে পারেন।



নারসিজমের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি বিখ্যাত ঘটনা ইতিহাসে অনেক প্রভাব ফেলেছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেওয়া হলো যা নারসিজমের প্রভাবকে তুলে ধরে:


নেপোলিয়ন বোনাপার্ট

    ফ্রান্সের সামরিক নেতা এবং সম্রাট, প্রায়ই নারসিস্টিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনের জন্য পরিচিত। তার নিজের গুরুত্বের প্রতি চরম বিশ্বাস, প্রশংসার ক্রমাগত প্রয়োজন এবং সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নারসিজমের লক্ষণ। যদিও তিনি সামরিকভাবে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন, তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল, যেমন ১৮১২ সালে রাশিয়া আক্রমণ করা। নিজের অপরাজেয়তার প্রতি বিশ্বাসের কারণে নেওয়া এই পদক্ষেপ তার সেনাবাহিনীর বিশাল ক্ষতির কারণ হয় এবং অবশেষে তার পতনের পথে নিয়ে যায়। "নেপোলিয়ন কমপ্লেক্স" কথাটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয় এমন কাউকে বর্ণনা করতে যিনি সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও নিজের ক্ষমতা বা গুরুত্বকে অতিরঞ্জিতভাবে বিশ্বাস করেন।


আডলফ হিটলার

    নাৎসি জার্মানির শাসক, চরম নারসিস্টিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতেন, বিশেষ করে আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, তার ব্যক্তিগত নিয়তি, এবং একটি "হাজার বছরের রাইখ" প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার বিশ্বাসে। হিটলার তার অনুসারীদের কাছ থেকে পুরোপুরি আনুগত্য এবং প্রশংসা দাবি করতেন, সহানুভূতির অভাব ছিল, এবং ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের প্রতি তার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল। তার এই বিরাট ও বদ্ধমূল বিশ্বাস ব্যবস্থা, যা মানবজীবনের প্রতি কোনো সম্মান দেখাত না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্টের মতো ভয়াবহ ঘটনার দিকে পরিচালিত করে। মিত্রশক্তির সামরিক শক্তিকে অবমূল্যায়ন করা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের মতো ভুল সিদ্ধান্তগুলো হিটলারের নারসিস্টিক ভ্রান্তিমূলক ধারণার কারণেই হয়েছিল।


টেড বান্ডি

    কুখ্যাত আমেরিকান সিরিয়াল কিলার, নারসিজমের আরেকটি ভয়ানক উদাহরণ। বান্ডি অত্যন্ত আকর্ষণীয়, প্রতারক এবং চরম নারসিস্টিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতেন, যেমন সহানুভূতির অভাব, নিজেকে অত্যন্ত বড় ভাবা এবং প্রশংসার জন্য তার প্যাথলজিকাল প্রয়োজন। তিনি তার আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে ভিকটিমদের কাছে আসতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে তিনি সকলের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান এবং ক্ষমতাবান, এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার থেকেও। তার এই নারসিস্টিক আত্মবিশ্বাস তাকে অপরাধ করতে আরও বেপরোয়া করে তোলে এবং একসময় তার পতন ঘটে।


এলিজাবেথ হোমস (থেরানোস কেলেঙ্কারি)

    থেরানোস নামে একটি স্বাস্থ্য প্রযুক্তি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, আধুনিক সময়ে কর্পোরেট জগতে নারসিজমের আরেকটি উদাহরণ। হোমস, যিনি বিপ্লবী মেডিক্যাল টেস্টিং প্রযুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, স্টিভ জবসের মতো ব্যক্তিত্বদের সাথে তুলনা করা হতো এবং তিনি তার উদ্ভাবনের জন্য প্রশংসা পেতেন। তবে, তার সাফল্য ছিল মিথ্যা এবং প্রতারণার ওপর ভিত্তি করে। তিনি পরীক্ষা ফলাফল জাল করতেন এবং বিনিয়োগকারী, সহযোগী এবং জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতেন। তার সহানুভূতির অভাব, প্রতারণা এবং নিজের সম্পর্কে চরম উচ্চ ধারণা তাকে সাম্প্রতিক সময়ের বৃহত্তম কর্পোরেট জালিয়াতির দিকে নিয়ে যায়। অবশেষে, হোমস ধরা পড়েন এবং প্রতারণার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।


এই ঘটনাগুলো দেখায় যে নেতৃত্বে নারসিজম নিয়ন্ত্রণহীন হলে তা কিভাবে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ