ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প ১০

অভিশপ্ত বাজি





ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় রফিক দৌড়াচ্ছিল, মুখে একরকম অস্থির হাসি, হাতে ধরা টাকার ব্যাগ । ক্রিকেট বাজি ধরা ছিল তার একমাত্র উত্তেজনা, তার জীবনের একঘেয়েমি থেকে পালানোর উপায়। প্রথমে বন্ধুদের সাথে মজা করে শুরু করলেও, অল্প সময়েই সে পুরোপুরি জড়িয়ে গেল এতে। আর যেদিন থেকে শহিদ তার জীবনে প্রবেশ করল, সেই দিন থেকে সবকিছুই বদলে গেল।


আরও ভূতের গল্প পড়ুন:

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প ৯


শহিদ ছিল অদ্ভুত এক লোক। সে সব সময় খেলার ফলাফল জানত। যতই অনিশ্চিত হোক ম্যাচ, শহিদ রফিকের কানে ফিসফিস করে বলে দিত আর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সবসময় সত্যি হতো। ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল, কিন্তু রফিক তাতে পাত্তা দিল না। তার চোখে ছিল শুধু টাকার পাহাড়, যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছিল।


এক সন্ধ্যায়, বড় অঙ্কের টাকা জেতার পর, শহিদ তাকে শহরের প্রান্তের পুরনো এক চায়ের দোকানে দেখা করতে বলল। বাতাসে ভারি আর্দ্রতা, আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছিল। রফিক যখন সেখানে পৌঁছাল, শহিদ আগেই সেখানে ছিল, অন্ধকারে মুড়ে থাকা তার অবয়ব। চায়ের দোকানের ক্ষীণ আলো তার মুখটুকু কোনোমতে আলোকিত করছিল।


"তুমি ভালো করেছো," শহিদ তার গম্ভীর কণ্ঠে বলল। "কিন্তু তুমি কত দূর যেতে পারবে?"


রফিক একটু থমকালো। এতদিন সে ছোট ছোট বাজি ধরছিল, কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছিল সে বড় কিছু করতে পারে। "আমি আরও চাই," আত্মবিশ্বাসের সুরে রফিক বলল।


শহিদ একটু এগিয়ে এসে বলল, তার চোখে এক ধরনের জ্বাজ্জ্বল্য ছিল। "আগামীকাল একটা ম্যাচ আছে। সবকিছু বাজি ধরো, রফিক। তুমি জিতবে। আমার বিশ্বাস করো।"


রফিকের শরীরে শিহরণ বয়ে গেল উত্তেজনায়। শহিদ যখন পাশে আছে, তার হারা সম্ভব নয়। পরের দিন, রফিক তার সমস্ত সঞ্চয়, তার জেতা সব টাকা, এমনকি ধার করা টাকাও বাজি ধরল। সবকিছুই ঝুঁকিতে ফেলে দিল সে।


কিন্তু এবার আর কিছুই তার পরিকল্পনা মতো হলো না।


ম্যাচ ছিল একেবারে ভয়াবহ। প্রতিটি বলের সাথে সাথে তার দল ধ্বংস হচ্ছিল আর তার সাথে ভেঙে পড়ছিল তার স্বপ্নগুলো। রফিক হতবাক হয়ে দেখল তার দলের পরাজয়, আর সাথে তার সবকিছুই শেষ হয়ে গেল।


বেপরোয়া হয়ে সে শহিদকে খুঁজতে বেরোল, যাকে সে শেষবার দেখেছিল পুরনো বাজারের পেছনের গলিতে। "তুমি বলেছিলে আমি জিতব!" চিৎকার করে বলল রফিক, তার গলায় আতঙ্ক।


শহিদ নিস্তেজভাবে তাকাল তার দিকে। "আমি কখন বলেছিলাম কবে জিতবে?"


"তুমি কী বলতে চাও? আমি সবকিছু বাজি ধরেছিলাম! আমি শেষ হয়ে গেছি!"


শহিদ ধীরে ধীরে দাঁড়াল, এবং রফিক প্রথমবার লক্ষ্য করল কিছু একটা অস্বাভাবিক। শহিদের চলাফেরায় কিছু অদ্ভুত, তার ছায়া ছিল অন্যরকম। "আমি তোমাকে শুধু টাকা জেতানোর জন্য এখানে আনিনি, রফিক। তোমার আসল পরীক্ষা এখন শুরু।"


রফিকের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। "তুমি কী বলছো?"


শহিদ আরও কাছে এগিয়ে এলো, তার মুখে এক অন্ধকার ছায়া। "আমি শুধু মানুষ নই। আমি অভিশপ্ত, ঋণে বাঁধা পড়ে আছি, যেমন তুমিও এখন। কিন্তু একটা পথ আছে।”


রফিকের হৃদয় থেমে যেতে চাইছিল। "তুমি কী বলতে চাও?"


"তুমি সবকিছু হারিয়েছো, কিন্তু ঋণ শোধ করার একটা উপায় আছে। একটা জীবন, তোমার মুক্তির বিনিময়ে।"


রফিকের শরীরে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। "তুমি আমাকে কাউকে খুন করতে বলছো?"


শহিদের কণ্ঠে ছিল এক ভয়ঙ্কর নীরবতা। "এটাই একমাত্র উপায়। একটা জীবন নাও, নইলে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমাকেও এই একই পছন্দ দেওয়া হয়েছিল অনেক আগে। এখন, তুমিই সিদ্ধান্ত নাও।"


শব্দগুলো বাতাসে ঝুলে রইল, রফিকের চারপাশে শূন্যতা তৈরি করতে লাগল। তার মন ছুটছিল, আতঙ্ক তার ভেতরে বাসা বাঁধছিল। এটা সে চায়নি। বাজি ধরা ছিল শুধু একটা খেলা, টাকা জেতার একটা সহজ উপায়। কিন্তু এখন তা এমন কিছুতে পরিণত হয়েছে, যা তার কল্পনার বাইরে, এক অন্ধকার পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তাকে।


"আমি এটা করতে পারব না," রফিক বলল, তার কণ্ঠ কাঁপছিল।


"তোমার আর কোনো উপায় নেই," শহিদ বলল, তার চোখ রফিকের সাথে লেগে রইল, সেগুলো যেন এক অন্ধকার খাদের মতো গভীর। "ঋণ শোধ করতেই হবে।"


রফিক পিছিয়ে গেল, তার মন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে কখনোই কাউকে খুন করতে পারবে না। কিন্তু শহিদের অবয়ব যখন বিকৃত হয়ে ছায়ার মতো দেখতে লাগল, রফিক বুঝতে পারল যে সে না করলেও শীঘ্রই তার ভাগ্যও শহিদের মতোই হবে—এক অভিশপ্ত আত্মা, এই অন্ধকার জগতে চিরতরে আটকা পড়ে থাকবে।


তার সামনে শুধু দুটো পথ খোলা ছিল। নিজের জীবন বা অন্য কারও।


এই সিদ্ধান্তের ভার তার ওপর নেমে এল, আর চারপাশের ঢাকা শহরের কোলাহল তার কানে আসা বন্ধ হয়ে গেল। রফিক দাঁড়িয়ে রইল, শহিদের চোখের গভীরে তাকিয়ে, আর বুঝতে পারল যে এই অন্ধকার থেকে পালানোর আর কোনো পথ নেই।


এই জীবন থেকে মুক্তি নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ