ঢাকার কথা ভাবলে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্যস্ত রাস্তা, রিকশা, আর কোলাহলপূর্ণ ট্রাফিকের ছবি। কিন্তু এই চিত্রের পেছনে আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর ঐতিহ্যবাহী নগরী, যা আবিষ্কারের অপেক্ষায়। সম্প্রতি ঢাকায় ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে আমি শহরের কিছু আইকনিক স্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগ পাই, এবং তা কেবল একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি শহরের আত্মার সাথে গভীর সংযোগের মতো ছিল।
### **১. লালবাগ কেল্লা **
আমার যাত্রা শুরু হয় **লালবাগ কেল্লা** থেকে, যা ঢাকার পুরান অংশে অবস্থিত এক চমৎকার মুঘল দুর্গ। এই দূর্গের উচ্চ প্রাচীরগুলো আমাকে ১৭শ শতাব্দীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন মুঘলরা বাংলা শাসন করত। এর সুন্দর উদ্যান ও প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল যেন আমি এক ভিন্ন সময়ে প্রবেশ করেছি। লালবাগ মসজিদ এবং পারি বিবির সমাধি মুঘল যুগের বৈভবের এক ঝলক দেখিয়ে দেয়।
এই কেল্লা অপূর্ণ ইতিহাসের একটি প্রতীক, কারণ এর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। তবুও এর আকর্ষণ অনস্বীকার্য। কেল্লা থেকে আধুনিক ঢাকার স্কাইলাইন দেখা যায়, যা শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্যের সাথে মিলেমিশে ঢাকার ক্রমবিকাশের গল্প বলে।
### **২. ধাকেশ্বরী মন্দির**
ইসলামী ঐতিহ্যের লালবাগ থেকে আমি চলে যাই ঢাকার প্রাচীনতম হিন্দু মন্দির, **ধাকেশ্বরী মন্দিরে**। এটি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান পূজাস্থান। বলা হয়, এই মন্দির থেকেই ঢাকার নামকরণ হয়েছে। মন্দিরের শান্ত আঙিনায় হাঁটার সময় ঘণ্টাধ্বনি এবং পূজার সুর আমাকে এক ধ্যানমগ্ন পরিবেশে নিয়ে গিয়েছিল, যা মন্দিরের বাইরে থাকা কোলাহলের একদম বিপরীত।
### **৩. আহসান মঞ্জিল**
রিকশায় করে কিছুটা দূরত্ব পেরিয়ে আমি পৌঁছালাম **আহসান মঞ্জিল**, যা একসময় ঢাকার নবাবদের বাসভবন ছিল। পিংক প্যালেস নামে পরিচিত এই বিশাল প্রাসাদ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদটি এখন একটি জাদুঘর, এবং এর প্রতিটি কক্ষে ঢাকার নবাব পরিবারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এর ছাদ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর দৃশ্য মনোমুগ্ধকর।
### **৪. সদরঘাট এবং বুড়িগঙ্গা **
আহসান মঞ্জিল থেকে আমি যাই **সদরঘাটে**, যা ঢাকার প্রধান নদীবন্দর। এখানে হাজার হাজার নৌকা বড়-ছোট সব ধরনের মানুষের ভিড়ে পূর্ণ থাকে। নদীতে এত নৌকা চলাচল, মানুষের জীবনযাত্রা, আর এই দৃশ্য সত্যিই চিত্তাকর্ষক। বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় ভ্রমণ এক অনন্য অভিজ্ঞতা—এই ভ্রমণের মাধ্যমেই ঢাকার প্রকৃত সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা যায়। যখন আমরা নৌকা বেয়ে চলছিলাম, সূর্যাস্তের আলোয় ঢাকার স্কাইলাইন অসাধারণ লাগছিল।
### **৫. তারামসজিদ ও খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ**
ঢাকার দুইটি সুন্দর মসজিদ—**তারামসজিদ** এবং **খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ** আমার পরবর্তী গন্তব্য ছিল। তারামসজিদ, তার তারকাখচিত মোজাইকের জন্য বিখ্যাত, ইসলামী শিল্পের এক অপরূপ নিদর্শন। এর নীল ও সাদা নকশার শৈল্পিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কাছেই অবস্থিত খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, মুঘল স্থাপত্যের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ।
### **৬. জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ ও শহীদ **
ঢাকায় ভ্রমণের সমাপ্তি হতে পারে না দেশের গৌরবময় ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে। আমি গিয়েছিলাম **শহীদ মিনারে**, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত। এছাড়াও, শহরের বাইরে **জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ** স্বাধীনতার জন্য দেশের সংগ্রামের এক অপরিহার্য প্রতীক। এই দুই স্থানই আমাকে বাংলাদেশের মানুষের শক্তি ও দৃঢ়তা সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।
### **৭. টি.এস.সি. ও সদরঘাট**
দিনের শেষে, আমি যাই **টি.এস.সি (টিচার-স্টুডেন্ট সেন্টার)** এলাকায়, যা সন্ধ্যায় ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় মিলনস্থল। এখানে যুবক-যুবতীরা আড্ডা দিতে জড়ো হয়, রাস্তার খাবার উপভোগ করে, আর মাঝে মাঝে লাইভ মিউজিকও শোনা যায়। কাছেই স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাদের থেকে মশলাদার ফুচকা, চটপটি, আর ঠাণ্ডা বোরহানি খেয়ে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম।
শেষে, আমি আবার সদরঘাটে ফিরে যাই, বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে রাত্রিকালীন ব্যস্ততা দেখার জন্য। নৌকাগুলোর আলো, ইঞ্জিনের মৃদু শব্দ, আর ঠাণ্ডা রাতের হাওয়া পুরো দিনের ভাবনাগুলোকে নিঃশব্দে সমাপ্ত করে।
আরও পড়ুনঃ
পুরান ঢাকার বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট
0 মন্তব্যসমূহ